top of page
Search

বইমেলা

সুমিত বর্ধন


একটা বিশাল জনঅরণ্য রঙচঙে অজগরের মতো চুম্বকভাসি ট্রেনটার পেটের নানা খোপ থেকে প্ল্যাটফর্মে সর্ষেদানার মতো ছড়িয়ে যায়। অন্য কোন রবিবার হলে এ সময়ে হয়ত দু-চারজনের বেশী থাকতো না , কিন্তু আজ বইমেলার শেষ দিন, অতএব প্ল্যাটফর্মে পা রাখার জায়গা নেই । ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি করে সবাই এস্কালেটরের দিকে এগোয় ।


ভিড়ের মধ্যে আছে তিন বন্ধুও, অয়ন, কিংশুক আর ভাস্কর । তিনজনে এসেছে শহরের তিন প্রান্ত থেকে । আসার কথা ছিলো আরো আগে, কিন্তু কিংশুকের টার্মিনাসে আসতে দেরি করায় দুটো ট্রেন ছেড়ে এইটা ধরতে হলো ওদের।


ভাস্করের কাঁধে একটা আলতো চাপড় মারে অয়ন, “এস্কালেটর ছাড়, সিঁড়ি ধর। যা ভিড়, এদের পেছন পেছন মেলায় ঢুকলে আর একটা বইও পাওয়া যাবে না।”

“তিনটে তলা উঠতে হবে !” মৃদু প্রতিবাদ জানানোর চেষ্টা করে কিংশুক।

“তো ? উঠবি ! কেনো, সকাল থেকে উপোস করে আছিস নাকি ? চল, চল ।” ভিড়টাকে কোনাকুনি কাটিয়ে কিংশুকের হাত ধরে একরকম টানতে টানতে সিঁড়ির দিকে টেনে নিয়ে যায় ভাস্কর ।


সিঁড়িটা অবশ্য খালিই । ভিড়ের বেশিরভাগটাই এস্কালেটরের দিকে চলে গেছে। দু-একটা করে সিঁড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে তিনজনে । তবে কিংশুক একটু ভুল বলেছিলো, তিনটে নয়, চার-চারটে তলা উঠতে হয় তাদের। সিঁড়ির পর একটা লম্বা টানেলের মতো জায়গা, তার মাঝখানে পাতা লম্বা কনভেয়ার বেল্ট । ভিড় এখানেও কম, হয়তো সব নিচের এস্কালেটরেই আটকে আছে । ছুটতে ছুটতেই বেল্টে ওঠে তারা, রেলিঙের পাশে ‘ছোটা নিষেধ’ লেখা বোর্ডের সাবধানবাণীর তোয়াক্কা না করে হাঁটতে থাকে চলন্ত বেল্টের ওপর দিয়ে ।


কয়েকটা মিনিট বাদে ফুরিয়ে যায় টানেল, কনভেয়ার বেল্ট তাদের উগরে দেয় খোলা আকাশের ঝকঝকে নীলের নিচে । মেলার প্রাঙ্গণে মানুষের ভিড়, স্টলগুলোর মাথায় নিওনের রঙবাহার, বাতাসে উৎসবের মেজাজের সঙ্গে ফুডকোর্টের ঘ্রাণ আর বহু মানুষের কন্ঠস্বরের মিশ্রণ । দু-মিনিট দাঁড়িয়ে লম্বা নিশ্বাস টানে তিনজনেই ।

“এবার ?” চোখ তুলে প্রশ্ন করে কিংশুক ।

“ক্লোজিং সেরিমনি কটায় ?” উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করে ভাস্কর ।

আকাশের গায়ে দানবিক আলোর অক্ষরে আঁকা একটা টাইমারের দিকে আঙ্গুল তোলে অয়ন, “ঠিক এক ঘন্টা সাত মিনিট ।”

মাথা নাড়ে ভাস্কর, “তাহলে আর সবাই মিলে ঘুরে ঘুরে বেছে বই কেনার সময় নেই । যে যার লিস্ট মতো স্টল খুঁজে নিই । বই কিনে সোজা ক্লোজিং সেরিমনি , সেখানে দেখা হবে ।”

“ঠিক আছে । “ বলে কিংশুক , “তাহলে সেন্ট্রাল প্লাজায়, এক ঘন্টা বাদে ।”

“হ্যাঁ ।”

তিনজনে হনহনিয়ে হাঁটা দেয় তিনদিকে ।


হাতে বইয়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে তিনজনে যখন সেন্ট্রাল প্লাজায় আর একবার মুখোমুখি আসে তখন আকাশটা রঙ পালটে প্রুশিয়ান ব্লু হয়ে গেছে, জ্বলে উঠেছে মেলার আলোগুলো ।


স্টলের গুঁতোগুঁতি থেকে একটা বৈমাতৃসুলভ দূরত্ব রেখে মেলার ঠিক মাঝখানে সেন্ট্রাল প্লাজাটা ফ্লাডলাইটের ঝলকানির নিচে প্রহর গোনে । উঠোনের মতো ছড়ানো বিশাল চাতালটার একপাশে স্টেজ , আর অন্যদিকে দুফুট উঁচু পাড় দিয়ে গোল করে ঘেরা একটা জায়গা ।

কিংশুকের হাতের ভারী ব্যাগটার দিকে তাকায় ভাস্কর, “ওহ্‌, বাজী মাত করেছিস দেখছি ? কি কিনলি ?”

“রবীন্দ্র রচনাবলী । লাস্ট কপি । “ একটা গর্বের ছাপ ফুটে ওঠে কিংশুকের মুখে, “তোরা ?”

হাতের ব্যাগটা ওপরে তোলে ভাস্কর, “ব্যোমকেশ বক্সী আর নাট-বল্টু-চক্র ।”

“আমি স্রেফ কবিতা ।” হাতে ধরা একগোছা পাতলা বই মাথার ওপর তুলে নাড়ায় অয়ন, “শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গাঙ্গুলী, যা যা পেয়েছি তুলে এনেছি । স্টক না শেষ হয়ে গেলে আরো কয়েকটা কিনতাম । আজকের জন্যে এটাই বেস্ট ।”

প্রহর গোনা শেষ হয় । কোথাও অলক্ষ্যে একটা ঘন্টা বেজে ওঠে । স্টেজের পেছন থেকে একঝাঁক ক্যামেরা ড্রোন শিকারী পাখির মতো উড়ে আসে ওপরে । ফ্লাডলাইটের আলোগুলো আচমকাই বেঁকে গিয়ে পড়ে স্টেজের ওপর। তার পেছনের অন্ধকার থেকে আলোর বৃত্তের মধ্যে এগিয়ে আসেন একজন মানুষ, চেহারায়, পোশাকে আর হাঁটার ভঙ্গীতে তাঁর আভিজাত্য আর দৃড়তার ছাপ ।


“নমস্কার ! গম্ভীর ঘন্টার নিঃস্বনের মত তাঁর সম্ভাষণ ছড়িয়ে যায় মেলার চারপাশে । হর্ষধ্বনিতে প্রত্যুত্তর দেয় জড় হওয়া জন অরণ্য । একটা তির্য্যক আলোর রেখা মঞ্চ থেকে ছুটে যায় আকাশের দিকে । প্রুশিয়ান ব্লুর পটভূমিকায় ফুটে ওঠে স্টেজের বক্তার ধবেধবে চুলদাড়ির ফ্রেমের মাঝের জ্ঞানগম্ভীর মুখখানা ।

“নমস্কার, আজ বইমেলার শেষ দিন, আর সূচনা এক নতুন দিনের ।” তাঁর গলা ছড়িয়ে যায় চারপাশে ।

“বই । কাগজে লেখা কালিতে ছাপা ছোট ছোট অক্ষর । ঘাড় গুঁজে পড়তে হয় । যে জ্ঞান অনায়াসে একটা ভিডিও দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, অনায়াসে দেখা যায় , তাকে এইভাবে কষ্ট করে মাথায় ঢোকাতে চাওয়ার কোন যুক্তি আছে ?”

“না !” সমস্বরে চিৎকার করে মানুষের ভিড় ।

“আর বিষয় ? কাল একটা কবিতার একটা লাইন একজন আমাকে শোনালো - ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল। রোদের কি কোন গন্ধ থাকে ? আর থাকলেও চিল সে গন্ধ মুছবেই বা কি করে ? এ সব কথা আজগুবি নয় ? বলুন, আপনারাই বলুন ।”

“হ্যাঁ !” প্রুশিয়ান ব্লু থেকে ধীরে ধীরে কালো হয়ে আসা আকাশকে চ্যালেঞ্জ জানায় মানুষের চিৎকার ।

“ছোটবেলায় একটা গল্প পড়েছিলাম , ক্ষুধিত পাষাণ । একে তো নামটারই কোন মানে হয় না । পাথরের কি ক্ষিধে পায় ? কি অবৈজ্ঞানিক ধারণা ! আর সে গল্পের বিষয়ও তেমনি মারাত্মক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ধোঁয়াটে, বিন্দুমাত্র সামাজিক বা শিক্ষামূলক কোন বক্তব্য নেই । আমাদের কি এই ধরণের বিষয়ের প্রয়োজন আছে ?”

“না ! “ চিৎকারে গলা মেলায় অয়ন, কিংশুক আর ভাস্করও ।

“বই অপ্রয়োজনীয়, বই ফেলে আসা শতাব্দীর কুশিক্ষার বোঝা, বই নিরর্থক, বই প্রগতির আর প্রযুক্তির শত্রু । আসুন বই থেকে মুক্ত হই ।”

স্টেজের উল্টোদিকের গোল বেড় দেওয়া জায়গটার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে গ্যাসের আগুনের অগুন্তি নীল শিখা।

কৃষ্ণকালো আকাশে জ্ঞানবৃদ্ধের প্রতিচ্ছবির নিচে আগুনে নীল পদ্মফুল ।

সোল্লাসে চিৎকার করে ওঠে মানুষের জমায়েত । পাগলের মতো ঠেলাঠেলি করে আগুনের কাছে গিয়ে বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলে আগুনের মধ্যে । তাদের সঙ্গে যোগ দেয় অয়ন, কিংশুক আর ভাস্করও । পাতার পর রবীন্দ্রনাথের পাতা , আর শরদিন্দু আর সুনীল আর শক্তি আর অদ্রীশ আর আরো যা যা কিছু সব আকাশ কাঁপানো উল্লাসে অঞ্জলি দেয় অগ্নিপুষ্পে ।


ক্লোজিং সেরিমনিতে মানুষের ভিড়, স্টলগুলোর মাথায় নিওনের রঙবাহার, বাতাসে উৎসবের মেজাজের সঙ্গে কাগজ পোড়া ঘ্রাণের মিশ্রণ ।


 

কৈফেয়ৎ - ব্র্যাডবেরির ‘দ্য এক্সাইলস’ গল্পটা অনুবাদ করতে গিয়ে মনে হলো গল্পটার একটা পূর্ব্ব অধ্যায় তো হতেই পারে । তাই কেমন আপনমনেই এটা লেখা হয়ে গেলো । এটা গল্প , তবে অসম্ভব হয়তো নয়, কারণ ইতিহাসে এমন উদাহরণ আছে । ১৪৯৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে পাদ্রী সাভানারোলার অনুগামীরা অতি বিলাসিতার অভিযোগ তুলে ফ্লোরেন্সের চত্বরে এই ভাবেই পুড়িয়ে দিয়েছিল বই আর শিল্পকলা।


374 views0 comments

Recent Posts

See All
bottom of page